জামায়াতের ‘দুর্ভেদ্য ঘাঁটি’ ভেঙে চুরমার

বিএনপি এবারের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের অস্তিত্ব রক্ষার শেষ অস্ত্র হিসেবে তাদের জন্য ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ রাখে বিজয়ের এই মাসে তুমুল সমালোচনার পরও। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। সারাদেশ তো বটেই, জামায়াতের অন্যতম দুর্গখ্যাত দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় দলটির ঘাঁটি ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।

নির্বাচনের আগে আমাদের সময়ের সরেজমিন প্রতিবেদনেও অবশ্য এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের ২১ নেতা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলেন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির আমাদের সময়কে বলেন, জামায়াতকে ধানের শীষে নির্বাচন করার সুযোগ দিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের দায় কাঁধে নিয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম নির্বাচন কমিশন তাদের প্রার্থিতা বাতিল করবে। যা-ই হোক, আশার কথা এই যে, বিজয়ের মাসে সাধারণ মানুষ তাদের বয়কট করেছে। জামায়াতের মজবুত দুর্গে আঘাত হেনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের ২৫ নেতা এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ২১ জন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। বাকি চার জন ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাদের মধ্যেও একজনকে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে বিএনপি।

যুদ্ধাপরাধীদের দল এবং পরিবারের সদস্য হিসেবে এবার দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত ছিলেন জামায়াতের প্রার্থীরা। তাদের জন্য ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার খেসারত দিতে হলো বিএনপিকেও। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন জামায়াতের তকমা খুলতে অবশ্য এরই মধ্যে বলেছেন, জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হবে জানলে ঐক্যফ্রন্টে আসতাম না।

ভোটের ফল বলছে, বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি নিবন্ধন বাতিল হওয়া যুদ্ধাপরাধী এই দলের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত করে ছেড়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত কারাবন্দি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম বিন সাঈদী পিরোজপুর-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়ে জামানত হারিয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৮,৩০৮ ভোট।

তার বাবা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এই আসনে ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবার এবং ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হন জামায়াতের আব্দুল হাকিম। তিনি নাশকতার মামলায় বর্তমানে কারাগারে। ১৫,৬৩৮ ভোট পেয়ে তিনিও জামানত হারিয়েছেন। খুলনা বিভাগে জামায়াতের মজবুত ঘাঁটি সাতক্ষীরা-২ আসনে জেলা জামায়াতের আমীর মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। গত জুন মাস থেকে তিনি কারাগারে।

এ আসনে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী সামসুর রহমান, ২০০১ সালে একই দলের নেতা আব্দুল খালেক মণ্ডল নির্বাচিত হন। সাতক্ষীরা-৪ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা গাজী নজরুল ইসলাম এবার ধানের শীষ নিয়ে লড়াই করে পেয়েছেন ৩০,৪৮৬ ভোট। তিনি ২০০১ সালেও জামায়াতের টিকিটে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।

চট্টগ্রাম-১৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হন জামায়াতের আ ন ম শামসুল ইসলাম। তিনি পেয়েছেন ২৪,২৩২ ভোট। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে খুলনা-৫ আসনে জামায়াত নেতা সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এবার তিনি পেয়েছেন ৩২,৬৯৪ ভোট। খুলনা-৬ আসনে জামায়াতের খুলনা জেলা শাখার আমির মাওলানা আবুল কালাম আজাদ নির্বাচন করেছেন। এ আসনে ইতিপূর্বে দুবার এমপি ছিলেন জামায়াত নেতা।

এবার ধানের শীষ নিয়ে লড়াই করে আবুল কালাম আজাদ পেয়েছেন ১৯,১০৫ ভোট। পাবনা-৫ আসনে জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ইকবাল হোসাইন ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়ে পেয়েছেন ২০,৬৪৫ ভোট। এটি জামায়াতের দুর্গখ্যাত আসনের একটি। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ কক্সবাজার-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও বিএনপির সমর্থন পেয়েছিলেন। বর্তমানে কারাবন্দি এই নেতা পেয়েছেন ১৮, ৫৮৭ ভোট।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাজিবুর রহমান পাবনা-১ আসনে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি জামানত হারিয়েছেন।

বগুড়ার আদমদীঘি এলাকার রাজাকার কমান্ডার ও বগুড়া-৩ আসনের সাবেক সাংসদ আবদুল মোমিন তালুকদার যুদ্ধাপরাধের মামলায় পলাতক। এবার বিএনপি প্রথমে মোমিন তালুকদারের স্ত্রী মাছুদা মোমিনকে মনোনয়ন দেয়। পরে তার ভাই আবদুল মুহিত তালুকদারকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের রায়ে মুহিত তালুকদারের প্রার্থিতা অবৈধ হয়ে যায়। এর পর মাছুদা মোমিনকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দের আদেশ দেন হাইকোর্ট। তিনি পেয়েছেন ৫৮,৫৮১ ভোট।–আমাদেরসময়